চল্লিশটি ছড়া দিয়ে সাজানো ছড়াকার রাসেল খান-এর শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ ‘ইচ্ছে আকাশ ছুঁই’। নামের মধ্যেই একটা শক্তি লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে আছে একটা স্বপ্ন। এই শক্তি বা স্বপ্নকে বহন করতে পেরেছে গ্রন্থটির অধিকাংশ ছড়া। ছড়াগুলোতে উঠে এসেছে শিশুদের কথা, তাদের সুখ ও দুঃখের কথা।
‘ইচ্ছে আকাশ ছুঁই’ গ্রন্থের প্রতিটি ছড়াই আলোচনাযোগ্য ও আবৃত্তিযোগ্য। যেহেতু সকল ছড়া নিয়ে আমি কথা বলতে পারব না, তাই আলাপের শুরুতেই সবার কাছে অনুরোধ—সবাই যেন চমৎকার এই বইটি পড়েন, কারণ এমন সাবলীল ও বৈচিত্রময় ছড়া সচরাচর দেখা যায় না।
আগেই বলেছি, ছড়াগুলোতে শিশুদের কথা উঠে এসেছে। বইয়ের প্রথম ছড়ায় আমরা তা দেখতে পাই। প্রথম ছড়া ‘আমায় ডাকে’। শিশুদের মন পাখির মতো। তাদের মন সবসময় উড়তে চায়। ঘুরতে চায়। কিন্তু কত্ত বাধা তাদের। ছড়াকার ছন্দছড়ায় শিশুদের মনের কথা বলছেন—
‘রোদের ডানায় স্বপ্ন আমার
গুমরে কাঁদে মা
চার দেয়ালের বন্দি জীবন
ভালো লাগে না।
শিশুদের কথা আরও বলেছেন ‘সুবোধ ছেলে’ ছড়াতেও। একজন শিশু সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি খেলারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু অভিভাবকরা এ ব্যাপারে খেয়াল করেন না। শিশুদের হয়ে সেটাই বলেছেন তিনি—
ভাবনা মায়ের পড়া নিয়ে
মানুষ হওয়া চাই
পড়া পড়া শুধুই পড়া
বিকল্প যে নাই।
খেলা ও পড়া, এই দুটো নিয়েই শিশুকাল, সেটাই বলছেন—
ক্যামনে বোঝাই মাকে আমি
পড়ার সাথেই খেলা
খুব প্রয়োজন সুস্থ দেহ
নয় তো অবহেলা।
ছড়ার শেষ স্তবকে বলা হয়েছে কিছুটা রাগি স্বরে-
বইয়ের সাথে থাকলে ডুবে
সকল খেলা ফেলে
তবেই আমি সবার সেরা
মায়ের সুবোধ ছেলে।
শিশুর অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকতে দেখা যায় ‘পড়া আর পড়া’ ছড়াতেও। প্রথম দু’ স্তবক এরকম—
কোমলমতি ছোট্ট শিশুর
কাঁধে বইয়ের ব্যাগ
মন ভরে না কখন জানি
পড়ার টেবিল ত্যাগ।
ইচ্ছেটাকে হয় না জানা
বইয়ে রাখে ডুব
ফুল পাখিরা অচেনা তাই
অবাক করে খুব!
প্রকৃত শিশুসাহিত্যিক তো তিনি, যিনি শিশুদের পাঠ করতে পারবেন আগাগোড়া। শিশুদের আনন্দ দেওয়ার মতো ছড়া লেখার পাশাপাশি তিনি লিখবেন শিশুদের অধিকারের কথা। সেদিক থেকে ছড়াকার রাসেল খান একজন সফল শিশুসাহিত্যিক এবং তাঁর ‘ইচ্ছে আকাশ ছুঁই’ একটি খাঁটি শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ।
মা-কে আমরা সবাই ভালোবাসি। আর ছোটরা তো মা বলতেই অজ্ঞান। প্রিয় মা-কে নিয়ে আছে ‘মায়ের পরশ’ শিরোনামে একটি ছড়া।
মা মা বলে যতই ডাকি
ভালো লাগে ততো
আর কে আছে দরদমাখা
মা-জননীর মতো?
শেষ স্তবকে মা ও সন্তানের পরষ্পর নিখাঁদ ভালোবাসার কথা বলছেন এভাবে—
মায়ের সোহাগ-ভালোবাসা
ব্যাকুল করে রাখে
একটু চোখের আড়াল হলেই
খোকন বলে ডাকে।
মা মানেই মমতাময়ী, সে মানুষের হোক বা পশুদের— ‘ইঁদুর ছানা’ ছড়াটি শিশুদের এই সংবাদই দেয়। প্রথম দু’ স্তবক দেখে আসি-
তরতরিয়ে ছুটে বেড়ায়
ছোট্ট ইঁদুর ছানা
ভয়টা মায়ের কখন যেন
রাক্ষসে দেয় হানা।
চুপটি করে ঘাপটি মেরে
কোথায় বসে থাকে?
ভাবনা শত মায়ের মনে
চোখে চোখে রাখে।
সবুজ-শ্যামল এই বাংলাদেশর সিংহভাগ সৌন্দর্য গ্রামে। কবি শহুরে বন্ধুদের তাই গ্রামে আসার নিমন্ত্রণ দিচ্ছেন ‘চলে এসো গাঁয়’ ছড়াতে। সাথেসাথে গ্রামের সৌন্দর্য বলে বাড়াচ্ছেন লোভ! কবি বলছেন—
শহর ছেড়ে বন্ধু আমার চলে এসো গাঁয়ে
সবুজ-শ্যামল মাঠের শোভা দেখবে হেঁটে পায়ে।
সকালবেলা হিম কুয়াশায় গরম ভাপা পিঠে
খেজুরগুড়ে পিঠাপুলি কী যে দারুণ মিঠে।
গ্রাম নিয়ে আরেকটি ছড়া ‘আমাদের গ্রাম’। প্রথম চার লাইন উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না—
তুলির আঁচড়ে আঁকা আমাদের গ্রাম
সবুজের সমারোহ সুখ অবিরাম।
গাছে গাছে পাতাদের সুর ঝিরঝির
শাখে শাখে মনকাড়া পাখিদের নীড়।
ছড়া কি শুধু গম্ভীর? ছড়া কি শুধু সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে লেখা হয়? মোটেই না। ছড়া যেমন ভাবায়, তেমনি আনন্দও দেয়। রাসেল খান তার পাঠকদের জন্য লিখেছেন এমন স্বাদের ছড়াও। ‘পুষি ক্যাট’ ছড়াটাই দেখুন না-
মিয়াঁও মিয়াঁও পুষি ক্যাট
ইঁদুর ছানা ধরছে ব্যাট
চার ছক্কায় হাঁকছে বল
সাবাস সাবাস ইঁদুর দল।
এ ক্ষেত্রে ‘হিংটং’ শিরোনামের ছড়াও উল্লেখযোগ্য—
বাঁশঝাড়ে রাতভর
হেঁটে চলে তরতর।
থেকে থেকে ছাড়ে হাঁক
পড়াশোনা পড়ে থাক।
আয় মেখে গায়ে রং
খেলি আজ হিংটং।
বৈচিত্রময় ছড়া দিয়ে সাজানো ‘ইচ্ছে আকাশ ছুঁই’ গ্রন্থটি শিশুদের হাতে তুলে দিলে ভালো হবে বৈ ক্ষতি হবে না বলেই মনে করি। গ্রন্থটি ছোটদের অনেককিছুই শেখাবে, ভাবাবে, এবং তাদের দেবে নির্মল আনন্দ।
নিসা মাহজাবীন-এর প্রচ্ছদ, শেখ সাদী-র অলংকরণে ‘ইচ্ছে আকাশ ছুঁই’ গ্রন্থটি ২০২৩ এর বইমেলা সামনে রেখে প্রকাশ করেছে প্রতিভা প্রকাশ। বইয়ের মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১৫০ টাকা।