রূপবতী, গুণবতী, মেধাবী ও শান্তশীষ্ট মেয়ে ছিল তাহিয়া। তবে বয়স কম হওয়ায় জীবনের সাথে সংগ্রাম করে বড় হয় নাই বলেই হয়তো যথাযথ প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠতে পারে নাই। তার গুণে মুগ্ধ হয়ে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, চেনা, অচেনা ও জানা অজানা লোকও মাঝে মধ্যে তার সান্নিধ্য পেলে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়ে যায়। তার এত গুণ সেই কি আর বোঝে! সে নিজের কাছে অন্য সাধারণ মানুষের মতো একজন নগণ্য মানুষই বটে। বিশেষত্বের তকমা কি আর কপালে লেপন করা আছে? তবে মানুষ কি অকারণেই ভালোবেসেছে, প্রশংসায় ভাসিয়ে চলেছে? তা আবার গ্রামের মানুষ সেই কি এমনি এমনি কারো প্রশংসা করে? যারা সামান্য অপছন্দের কিছু দেখলে সারাদিন ঢাক-ঢোল পিঠিয়ে দশ গ্রাম শুনিয়ে বদনাম করে। তারা কেন শুধু শুধু কারো প্রশংসা করবে? গ্রামের মানুষের সহজ সরল মন। তারা যেমন নিন্দা করতে জানে তেমনই প্রশংসায় পঞ্চমুখও করতে জানে। তাহিয়া গ্রামের স্কুল, কলেজ পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য শহরে পাড়ি জমিয়েছে। এখন, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। পড়ালেখায় ভালো বলে বাবা-মা বিয়ের ভালো ভালো সম্বন্ধ না করে দিয়েছেন কত তার হিসেব রাখার জন্য পাক্কা একজন হিসেবরক্ষক রাখলে মন্দ হতো না, অন্তত সঠিক হিসেবটা মিলত। তাহিয়ার বাবা মাস্টার মালেক আহমেদ গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার মা রোকসানা বেগম পড়ালেখা শেষ করে স্বামীর সেবাযত্ন করে ঘরের রাণী হয়ে সংসারের সব দায়িত্ব পালন করছেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তাহিয়া সবার বড়। শহরের গিয়ে একা মেয়ে মানুষ পড়াশোনা করবে সেটা গ্রামের মানুষ ভাবতেই পারে না। তবে তাহিয়া মাস্টারের মেয়ে বলে সামনাসামনি কেউ কিছু বলার সাহস করে নাই। তাই বলে মালেক সাহেবও মানুষের কানাঘুষা কথা শোনেনি এমনও না। তবে মালেক সাহেবের এসব কথায় কান দেওয়ার সময় আছে?
ঢাকা শহরের নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন স্বাধীনচেতা মানুষ ও ক্লাসের বন্ধুবান্ধব সব মিলিয়ে আনন্দের মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু হয়েছিল। কিন্তু করুণ নিয়তি জীবনকে সুন্দরভাবে শেষ হতে দিল না। তাহিয়া শহরের জীবনকে গ্রামের মতো প্রাণবন্ত ও সহজ, সরল কৃত্রিমতা মুক্ত মনে করেছিল। শহরের জীবন যে গ্রামের মতো এত প্রাকৃতিক ও ভেজাল মুক্ত নয় সেটা সেই বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল। তবে যেটুকু বাকি ছিল সেটুকু দিয়ে বাকি জীবন আনন্দদায়ক করাটাও মুশকিল ছিল। এই যেন তুফান শুরু হয়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করার আগে বৃষ্টি হয়ে শুষ্ক জমি ভিজিয়ে শান্ত হওয়ার মতো। এই বৃষ্টির পানিতে মাটি নষ্ট না হলেও বাইরে ভিজে যাওয়া অরক্ষিত অনেক জিনিসই নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো তাহিয়ার জীবনও অরক্ষিত অবস্থায় বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এই বুঝি জীবনের সবকিছু মাটির সাথে মিশে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তবুও হার না মানা বীরের মতো বেঁচে থাকার চেষ্টায় যেন এতটুকুও কমতি নেই। যদি নিজে নিজে মরেই যায় একূল ওকূল দুই কূলই তো যাবে। তাহিয়া মুসলিম শিক্ষিত পরিবারের ধার্মিক মেয়ে তার সেটা ভালোই জানা আছে। তাই সে বেঁচে থেকে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে হলেও কিছু করার চেষ্টা করা উচিত- সেটাই যেন সে নারীদের দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তাহিয়া বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিন থেকেই হাসিখুশি ছিল। গ্রামীণ জীবনে সে যথেষ্ট পরিমাণ পর্দাশীল ছিল। ঢাকা শহরের জীবনেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। তবে ছেলে,মেয়েদের অবাধে মেলামেশা তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। এতে যেন কোনো পাপ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চারমাসের মধ্যে সে এক হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। নাম তার দিপক পাল। তার ডিপার্টমেন্টেরই এক বছরের সিনিয়র বড়ভাই। মুসলিম পরিবারের কোনো ছেলে নয়, হিন্দু পরিবারের ছেলে। গ্রামের ধার্মিক ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনা মেয়ে তাহিয়া। সে সাধারণত কোনো হারাম প্রেমে জড়ানোর কথা নয়। যদি কোনো কারণে প্রেমে জড়িয়েও যায় তাহলেও একজন অমুসলিম ছেলের প্রেমে জড়ানোর কথা নয়। কিন্তু সে সবকিছুকে মিথ্যে প্রমাণিত করে প্রেমে জড়িয়ে গেল, তাও আবার অমুসলিম পরিবারের ছেলে। ভাবা যায়!
তাদের প্রথম দেখা হয়েছে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি অনুযায়ী জুনিয়র সিনিয়রদেরকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ও নিজের পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠাতে হয়। দিপক পালকে মেসেজ পাঠালে সেই প্রথমদিন সাধারণ কথাবার্তা বলা শেষ করে শেষ করে দেয়। কয়েকদিন পরপর দিপক পাল মুসলিম মেয়েদের টার্গেট করে মেসেজ পাঠিয়ে একদিন একেকটা কথা বলার মাধ্যমে তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে থাকে ও তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করে। এক জনেরটা আরেকজন জানে না। না করার পর, তাহিয়া তার সাথে প্রায় দুইমাস কথা বলে নাই। তারপরও দিপক পাল মাঝেমধ্যে মেসেজ পাঠিয়ে তার ভালোবাসা প্রকাশ করতেই থাকে। সরাসরি কথা বলত না, বিরক্তও করত না, তবে অনবরত মেসেজ পাঠাত। তাহিয়া মেসেজগুলো পড়ে কোনো উত্তর দিত না। দুইমাস পর অনবরত মেসেজ পেয়ে মন নরম হয়ে তার প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। তাহিয়া ভাবতে থাকে একটা ছেলে সত্যি এমন করে ভালোবাসতে পারে? তারপর ভাবতে ভাবতে আরো এক মাস কেটে গেল তবুও মেসেজের শেষ নেই। অবশেষে তাহিয়ার সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে যে বাধা সেটা কথা বলে পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। তাহিয়া বলে, আমি একজন মুসলিম মেয়ে হয়ে অন্য ধর্মের ছেলেকে কখনো বিয়ে করতে পারব না। পরিবারের কথা বাদই দিলাম। দিপক পাল মুসলিম ধর্ম গ্রহণ ও বিয়ে করার কথা বললে তাহিয়ার অবুঝ মন সাওয়াব ও পরকালে মুক্তির আশায় শয়তানের ফাঁদে পড়ে হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে গেল।
বিয়ের উদ্দেশ্যে প্রেম করা আর চুরি করে কুরবানি করা যে একই কথা সেটা তার জানা ছিল না। যে পথে পা দিল সে পথ পিচ্চিল, তলোয়ারের চেয়েও ধারালো ও আগুনে পরিপূর্ণ ছিল সেটা সে খেয়াল করেনি। তাদের এখন বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশেপাশের অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি হয়। দিপক পাল মাঝেমধ্যেই দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে। দেশের অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছি এবার দুজন চল দেশের বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। তাহিয়া বলল, পরিবার থেকে যেতে দেবে না। দিপক পাল বলল, আরে বাড়িতে বলবে কেন? আমরা দূরে কোথাও যাব না। আমাদের পাশের দেশ ভারতে কয়েকদিন ঘুরেই চলে আসব। তাহিয়া তবুও যেতে না চাইলে দিপক ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করলে রাজি হয়ে যায়। দুইজন ভারতে গিয়ে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে ও একসঙ্গে একই রুমে থাকতে বাধ্য করে। তার কিছুদিন পরে দার্জিলিংয়ের এক হোটেলে ওঠে। সেখানে তিনদিন থাকার পর তাকে সেখানে রেখেই দিপক বাংলাদেশে চলে আসে ও পড়ালেখায় মন দিয়ে পরবর্তী টার্গেট ঠিক করার চেষ্টা চালু রাখে। তাহিয়া আক্তারকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। তাহিয়াকে আসামে একমাস রাখার পর সৌদিআরব পাঠানো হয়। শুধু তাহিয়া একা নয় তার সাথে আরো একশ ঊনিশজনকে পাঠানো হয়। তার মধ্যে তার মতো বাংলাদেশী আরো অনেক আছে যাদেকে একই ভাবে ভারতের যৌনপল্লিতে রেখে আসা হয়েছে। শুধু যে বাংলাদেশী আছে এমন না? ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মিয়ানমারের মহিলারাও আছে। শুধু যে মুসলিম মেয়েরা আছে এমন না, অন্যান্য ধর্মের মেয়েরাও আছে। তাহিয়া সৌদিআরব তিনমাস থাকার পর এক সৌদির খুব বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। হোটেলের মালিকের সাথে কথা বলে তাহিয়াকে নিয়ে সে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসতে চায়। তাহিয়া যে বাংলাদেশী সে জানে না। সবাই জানে সে ভারতীয় নাগরিক। প্রথমে রাজি না হলেও মোটা অংকের টাকা দিলে রাজি হয়ে যায়। তবে তার দায়িত্ব সৌদির হাতে ছেড়ে দেয়। কক্সবাজারে আসার দুইদিন পর তাহিয়া পালিয়ে প্রথমে তার পরিবারের কাছে ও পরে তার পরিবারসহ পুলিশকে সবকিছু বলে।
পুলিশ দিপক পালকে ঢাকায় তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে আসে। আদালত তার সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে অবিশ্বাস্য সব তথ্য ওঠে আসতে থাকে। দিপক বলে, ভারতসহ বাংলাদেশ এবং তার আশে পাশের কয়েকটি দেশে তাদের একটি সংগঠন কাজ করছে। তারা সবাই কেউ হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ কিংবা অন্য পরিবারের সন্তান। প্রকৃতপক্ষে তাদের কোনো ধর্ম নেই। তারা ধর্মে বিশ্বাস করে না। সত্যি তো ধর্ম থাকলে তো কেউ ধর্মকে আশ্রয় করে অন্য ধর্মের ক্ষতি করতে পারে না। তাই তারা মুসলিম ধর্মের মেয়েদেরকে অন্য ধর্মের ছেলে দ্বারা ও অন্যান্য ধর্মের মেয়েকে মুসলিম পরিবারের ছেলে দ্বারা বা ভিন্ন ধর্মী পুরুষ দ্বারা পুরোচিত করে প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তবে সজাতি দ্বারাও যে প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে এমন করে না এমনও না। বলতে গেলে এটা একটা উগ্রবাদী সংগঠন। তাদের কাজই হচ্ছে এক ধর্মকে উস্কে দিয়ে অন্যধর্মকে বিনাশ করা চেষ্টা করা। ধর্মকে চিরতরে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা। আর এটা করার সহজ মাধ্যম হিসেবে বেঁচে নিয়েছে মেয়েদেরকে ব্যবহার করা। কিন্তু যিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করে মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশ দেওয়ার জন্য ধর্ম পাঠিয়েছেন তিনি এই উগ্রবাদী সংগঠনগুলোকে ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। দিপক আরো স্বীকার করেন, সেই এখন পর্যন্ত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মেয়ের জীবন নষ্ট করে ভারতের যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দিয়েছে। আদালত কতৃক তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্তডি করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়।
তাহিয়া তার সাথে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা যাতে বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর আর কোনো মেয়ের সাথে না ঘটে তার জন্য সে একটা অরাজনৈতিক, অব্যবসায়িক, সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সংগঠনের কাজই হচ্ছে বিশ্বের নারীদের সচেতন করা। এই সংগঠন শিশুদের নিয়েও একটি কাজ করে। সেটা হচ্ছে – সন্তানকে ছোট থেকেই ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা। এই সংগঠনের স্লোগান হচ্ছে – ‘নারী তুমি সচেতন হও, তুমি সচেতন হলে, সচেতন হবে বিশ্ব।’ এই সংগঠন শুধু মুসলিম নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে না। এই সংগঠন বিশ্বের সব ধর্মের নারী ও শিশুদের নিয়েও কাজ করে। তাহিয়া চায় না তার মতো হাজার হাজার নারীকে এখনো যারা হাতের পুতুল বানিয়ে যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করার পর ফেলে দিক। নারীদের অনেক সম্মান, তাই তো প্রত্যেক ধর্মেই তার উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। ইসলাম ধর্মে নারীদের সম্মান দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত ।‘ আমরা সবাই কোনো না কোনো মায়ের পেট থেকেই এসেছি আর তার পায়ের নিচেই আমাদের সবার বেহেশত বা স্বর্গ। নারী সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দরতম প্রাণী। তার সম্মানও পৃথিবীর সবকিছু থেকে বেশি। তার সম্ভ্রমহানি হয় এমন কাজ করা কারো উচিত নয়।