Warning: Undefined array key "weather_location" in /home/kolombaz/public_html/wp-content/plugins/jnews-weather/class.jnews-weather.php on line 64
সহযাত্রী – Kolombaz

সহযাত্রী

ব্যবসায়িক কাজে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। দুইদিনের সফরসূচি থাকলেও কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় রাতের ট্রেনেই ঢাকায় ফিরছি। কাউন্টারে টিকেট না পেলেও ১০০ টাকা বেশি দামে কাউন্টারের সামনেই দালালের কাছে পেয়ে গেলাম টিকেট। শোভন চেয়ার উইন্ডো সিট। আধাঘণ্টা পর ট্রেন ছাড়বে। এই ফাঁকে রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। সঙ্গে থাকা লোকজনকে বিদায় জানিয়ে বগিতে উঠে দেখি আমার সিটে বসে আছে এক অষ্টাদশী ললনা। পাশের সিটে তার মামি। সিটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার দুই মামাতো ভাই। যাত্রী মূলত অষ্টাদশী একলাই। বাকিরা তাকে বিদায় জানাতে এসেছে। আমাকে দেখে মামি উঠে সিট ছেড়ে দিল। উপরের কম্পাউন্ডে নিজের ব্যাগ তুলে রেখে সিটে বসলাম। ট্রেন হুইশেল বাজাচ্ছে। একটু পরেই ছেড়ে দিবে। এদিকে তাদের বিদায় পর্ব শেষ হচ্ছে না। মামি আমাকে প্রশ্ন করল- আপনি কোথায় নামবেন? বললাম- কমলাপুর। বলল- তাহলে ওর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। আমি সম্মতি জানালাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। তারাও বিদায় নিয়ে নেমে পড়ল।

টিকেট অনুযায়ী আমার সিট জানালার পাশেরটা। জানালার সিটে বসে ভ্রমণ আমার খুব পছন্দের। এতে যেতে যেতে প্রকৃতির নানান দৃশ্য অবলোকন করা যায়, সেই সাথে মুক্ত হাওয়ায় নিশ্বাস নেয়ার সুযোগ তো আছেই। ঢাকায় পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে। ভাবলাম রাতের নিস্তব্ধতা আর ভোরের সূর্য ওঠা আজ ট্রেনে বসেই উপভোগ করব দারুণভাবে। সে চিন্তা থেকেই ১০০ টাকা বেশিতে উইন্ডো সিট নেয়া। কিন্তু সে সিট আর ভাগ্য- দুটোই দখল করে বসে আছে অপরিচিতা সুন্দরী। সিট চেঞ্জের কথা বলতে গিয়েও বলা গেল না। একটি সুন্দরী ললনাকে জানালার পাশের সিট ছেড়ে দিতে বলা কেন জানি অভদ্রতা এবং স্বার্থপরতা বলে মনে হল। তাছাড়া আমাকে উইন্ডো সিট ছাড়তে গেলে তাকে মাঝের সিটে বসতে হবে। ট্রেনের মাঝগলি দিয়ে যেভাবে সারাক্ষণ হকার আর বিভিন্ন যাত্রীরা আসা-যাওয়া করে, তাতে তাকে মাঝের সিটে বসাতেও মন সায় দিল না। অগত্যা সিট বদলের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমি মোবাইল টেপা ধরলাম।

সারাদিন ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকায় মোবাইল হাতে নেইনি খুব একটা। এখন দেখি নোটিফিকেশন আর মেসেজে সয়লাব। ট্রেনে বসে আর তো কোনো কাজ নেই। একটা একটা করে রিপ্লাই দিচ্ছি। পাশে বসা ললনা ট্যারা চোখে আমার স্ক্রিনের লেখা পড়ছিল। পড়ুক, তাতে কী! আমি তো আর গার্লফ্রেন্ডের সাথে চ্যাটিং করতেছি না যে – অন্যকেউ মেসেজ পড়লে লজ্জায় পড়তে হবে।

আন্তঃনগর ট্রেনের শোভন চেয়ারের বগিগুলো সাধারণত অর্ধেক সিট একমুখো বাকি অর্ধেক সিট উল্টোমুখো হয়ে থাকে। ঘটনাচক্রে আমাদের সিট মাঝখানে। আমাদের মুখোমুখি সিটে বসে আছে দুই ভারতীয় মহিলা। কথা শুনে বুঝলাম বাংলাদেশে কোনো আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে এসেছে তারা। একজন পৌঢ়, অন্যজন বৃদ্ধা। সম্পর্কে মা-মেয়ে। কখনো হিন্দি কখনো কলকাতার বাংলায় বকবক করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। তাদের কথায় কান না দিয়ে আমি মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত। এক ফাঁকে দু’তিনটা দরকারি কলও সেরে নিলাম। পাশে বসা অষ্টাদশী চুপচাপ আমার আর দুই-মহিলার তামাশা দেখছিল।

মেয়েমানুষ সাধারণত কথা না বলে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। তার উপর ঢাকা-চট্টগ্রামের এই লম্বা জার্নিতে একা একা- পুরোই বোরিং অবস্থা। নিজের বোরিং অবস্থা কাটাতে একটা সময় আগবাড়িয়ে কথা বলল সুন্দরী।
– কী নাম আপনার?
– জামশেদ। আপনার নাম?
– রুহি।
– সুন্দর নাম।
– থ্যাঙ্কস। কী করেন আপনি?
– উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু করি না।
– মিথ্যে বলছেন কেন! একটু আগেও তো দেখলাম কার সাথে যেন ব্যবসা নিয়ে কথা বলছেন।
– ও তেমন কিছু না। টুকটাক বিজনেস ।
– আচ্ছা বুঝছি। না বলতে চাইলে জোর করবো না।
এরপর আরও বেশকিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো দু’জনাতে।

ঘণ্টাখানেক ধরে ট্রেন চলছে। আস্তে আস্তে রাত গভীর হচ্ছে। যাত্রীদের অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রুহি তার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমিও এফএম অন করে হেডফোন কানে লাগিয়ে গা এলিয়ে দিলাম ঘুমের আশায়।

ঘুমের ঘোরে চুলের সুগন্ধি নাকে এলো। কাঁধের উপর কিছু একটার উপস্থিতি অনুভব করলাম। চোখ মেলে দেখি রুহির মাথা ঢলে পড়েছে আমার কাঁধের উপর। সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ভাবলাম তার মাথাটা সরিয়ে দেব অথবা আমি বামদিকে সরে বসবো, যাতে তার মাথা থেকে আমার কাঁধটা সরে যায়। সরে যাই যাই করে শেষ পর্যন্ত সরা হলো না আর। তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে হলো না। তাছাড়া তার স্পর্শ যে আমার খারাপ লাগছিল, তাও না। এক অজানা সুখের শিহরণ ছুঁয়ে গেল শরীর ও মনে। মোহগ্রস্ত আমি ঘুমিয়ে রইলাম সেভাবেই।

ট্রেনের ঝাঁকুনি আর সামনের আন্টিদের বকবকানিতে ঘুমানো বড় দায়। তার উপর একটু পর পর হকারে চিল্লা-পাল্লা। পাঁচ মিনিট ঘুমাই, তো দশ মিনিট জেগে থাকি- এই হলো অবস্থা। রুহিরও একই দশা। ঘুমে বেচারির চোখ লাল হয়ে উঠছে, অথচ ঘুমাতে পারছে না মোটে।

রাত ভোর হতে চলল। ট্রেন ভৈরব পার হয়েছে। “কফি…গরম কফি.…” হাঁক শোনা গেল। রুহিকে জিজ্ঞেস করলাম কফি চলবে কিনা। হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। দুটো কফি নিয়ে একটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। কফিতে চুমুক দিয়ে রুহি নিজের ফেসবুক ওপেন করল। আইডিতে নাম দেখি “নীল পরি”। “নীল পরী” নামের রহস্য জানতে চাইলাম। বলল- রিয়েল নামে আইডি চালাতে গেলে লোকে ডিস্টার্ব করে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা অবশ্য একটা কমন সমস্যা। কফি খেতে খেতে তার আইডিটা ঘুরে দেখলাম। রুহি সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জানা হলো। সে কিশোরগঞ্জের গরুদয়াল কলেজের অনার্সের ছাত্রী।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পূর্বাকাশে সোনালি সূর্য দেখা যাচ্ছে। রুহির গন্তব্যস্থল এসে গেছে। স্টেশনে এসে ট্রেন থামলো। কফির জন্য, সঙ্গদানের জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রুহি ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।
সামনে বসা আন্টি প্রশ্ন করলো-তুমি নামবে না?
– না।
– কেন, তোমরা দু’জন একসাথে না?
– না, আমার সাথে তার ট্রেনেই পরিচয়।
আন্টির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে- আমরা কেবল ট্রেনের সহযাত্রী ছিলাম।

ট্রেন থেকে নেমে রুহি আবারও হাত নেড়ে বিদায় জানালো। জানালায় মুখ বাড়িয়ে আমিও তাকে বিদায় জানালাম। স্নিগ্ধতায় ভরা এক মায়াবী হাসির রেখা ফুটে উঠল তার মুখে। এমন মায়াবী হাসির অষ্টাদশী ললনার সাক্ষাত জীবনে খুব বেশিবার পাইনি আমি। রুহি বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো। ট্রেনে এতক্ষণ একটা বিষয় খেয়াল করিনি- রুহির দু’পায়ে নুপূর পরা ছিল। ভোরের কুয়াশায় ভেজা পথে নুপূরের ছন্দ তুলে তার হেঁটে চলা দেখতে থাকি। তার হাসিতে, তার পথচলাতে অসম্ভব মায়া। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে মায়ায় ডুবে থাকি দীর্ঘক্ষণ। অথচ সে মায়ার কোনো শেকড় ধরে রাখিনি। রাখিনি তার সাথে যোগাযোগের নম্বর, যুক্ত করিনি ফেসবুক লিস্টেও। কারণ মায়া হচ্ছে স্বর্ণলতা লতার মতো। একটু অবলম্বন পেলেই তা হু হু করে বাড়তে থাকে। এই জীবনে মায়ার জালে বন্দি হওয়ার কোনো ইচ্ছে যে আমার নেই।

Exit mobile version